বিভিন্ন সবজি উৎপাদনে বীজের হার ও বীজতলায় বীজ বপন পদ্ধতি কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে সফলভাবে ফসল জন্মানোর জন্য যে পরিমাণ বীজ বপন/রোপণ করা হয় তাকে সেই ফসলের বীজ হার বলে। ফসলের বৈশিষ্ট্য তথা লতানো, ঝোপালো, কুঁশি সংখ্যা, পাতার আকৃতি, গাছ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা, ডালপালার পরিমাণ ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে একক জমিতে বীজের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। বীজ বপনের দূরত্ব ও পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে নিচের সূত্র অনুযায়ী বীজ হার নির্ণয় করা হয়। এ নিয়মে বীজের পরিমাণ প্রধানত চারা করে রোপণ পদ্ধতিতে আবাদকৃত সবজির জন্য প্রযোজ্য।
উদাহরণঃ এক একর বাঁধাকপির জমিতে ১৪৫২০ টি চারা লাগানোর দরকার। এক্ষেত্রে ১০০টি বীজের ওজন ৪ গ্রাম, তার বিশুদ্ধতা ৯৫% অঙ্কুরোদগম ৯০% এবং বীজতলায় বাস্তবে সম্ভাব্য অঙ্কুরোদগম ৮০% হলে বীজহার হবে নিম্নরূপ ।
অর্থাৎ অঙ্কুরিত সব চারা জমিতে রোপণ ও আশানুরূপ ফসল পেতে হলে প্রতি একরে ৮৪.৯১ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হবে। কিন্তু অঙ্কুরিত সব চারা রোপণ করা সম্ভব হয় না বা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদন হয় না। এ অবস্থায় নির্ণীত পরিমাণ বীজ গজানোর পর শতকরা যতভাগ চারা রোপণ বা নিদৃষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদন উপযোগী হয় তার ভিত্তিতে পরিমাণ নির্ণয় করলে প্রকৃত বীজ হার পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ৬০% চারা যদি রোপণ করা হয় বা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়। তাহলে প্রকৃত বীজ হার হবে ৬০% -এর জন্য ৮৪.৯১ গ্রাম এবং
৪০% এর জন্য প্রয়োজন = ৩৫.৮৪ গ্রাম
এখন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থাৎ সম্পূর্ণ ফসল উৎপাদনের জন্য ৮৯.৬২ + ৩৫.৮৪ = ১২৫.৪৬ গ্রাম বীজাহার ধার্য করতে হবে। বর্ষাকাল বা শীতকালে আগাম সবজির চারা তৈরি করার সময় বৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় ।
বীজ ছিটিয়ে বপন করলে সারিতে বপন করার চেয়ে ১.৫-২ গুণ বেশি বীজ লাগে । আবার চারা তৈরি করে রোপণ করা হলে সারিতে বপনের ক্ষেত্রে মাত্র অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ বীজ দরকার হয় ।
বীজ বপন/রোপণ (লতা, কন্দ, মূল, চারা, মুখী) হার হেক্টরপ্রতি ছকে দেখানো হলো ।
বীজতলায় বীজ বপন পদ্ধতি
জমিতে 'জো' অবস্থায় বীজতলার মাটি সমতল ও পরিপাটি করে তারপর ছিটিয়ে বা সারিতে বীজ বপন করতে হয়। তবে ৪-৫ সে.মি. পর পর অগভীর খাদ বা নালা কেটে পাতলা করে সারিতে বীজ বপন করা উত্তম। ক্ষুদ্রাকৃতির বীজের সাথে শুষ্ক বালি বা ছাই মিশিয়ে নিলে বপন করতে সুবিধা হয়। বীজ বপনের পর পচা গোবর বা কম্পোষ্ট সার মিশ্রিত মিহি বা ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ১-১.৫ সেমি পুরু করে বীজ ঢেকে হাল্কাভাবে মাটির সাথে চেপে দিতে হয়। আবহাওয়া বেশি শুষ্ক বা ঠান্ডা হলে খড়ের মালচিং দেওয়া ভাল। চারা গজানোর সংগে সংগে মালচিং সরিয়ে দিতে হয়। বৃষ্টি বাদলের সময়ে ৩-৫ সে.মি. লম্বা করে ধান বা গমের খড় কেটে বীজতলার উপরে ছড়িয়ে দিলে বীজতলার মাটির বা বীজ অপসারিত হয় না। চারা ঘন হলে বা বেশিদিন বীজতলায় থাকলে পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় সেগুলো দুর্বল ও লিকলিকে হয়ে যায়। দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরের পরিকল্পনা না থাকলে ঘন করে বীজ বপন করা অনুচিত। পাতলা করে বীজ বপন করে বীজতলায় পরস্পর থেকে ৪-৫ সে.মি. দূরত্বে রাখা হলে চারা সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে পারে।
বীজতলার পরিচর্যা
চারা গজানোর পূর্বে বীজতলায় পানি সিঞ্চন না করাই উচিত। তবে চারা গজানোর পর কাল বিকালে ঝাঁঝরি দিয়ে খুব নিচু থেকে পরিমিত পানি সিঞ্চন করা উচিত। বীজতলায় অতিরিক্ত পানি দেয়া হলে মাটিতে চাটা বেঁধে বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় ও অক্সিজেনের অভাবে বা গ্যাস জমে চারার ক্ষতি করে। তাই মাঝে মাঝে বীজতলার মাটি খচিয়ে আগল করে দিতে হয়। চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করা না হলে বৃষ্টি বাদলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে চারার গোড়া অনেক সময় বাঁকা হয়ে যায়, গুচ্ছমূল যথারীতি বাড়তে পারে না। ফলে অধিকাংশ চারা বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই চারা গজানোর পর এরূপ অসুবিধা দেখা দিলে ২-৩ কিস্তিতে চারার গোড়ায় ১.৫-২ সেমি. পুরু করে ঝুরঝুরে প্রকৃতির মিহি গুঁড়ো করা দো-আঁশ মাটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে চারা সোজা থাকে। সারিতে বীজ বুনলে দু'সারির মধ্য দিয়ে সহজেই মাটি দেয়া যায়। কিন্তু ছিটিয়ে বীজ বুনলে চালনীতে পুঁড়ো মাটি নিয়ে চারার উপর দিয়ে চেলে বীজতলার উপরে ফেলতে হয় ও পরে চারাগুলিকে সোজা করে দিতে হয়। পাতা ভেজা অবস্থায় মাটি প্রয়োগ করা অনুচিত।
কচি চারা প্রখর রোদ সহ্য করতে ও মাটি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি গ্রহণ করতে পারে না। তাই ঐ বয়সে প্রখর রোদে বীজতলার মাটি শুকিয়ে গেলে তাপদগ্ধ হয়ে চারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পক্ষান্তরে শিকড় যথাযথভাবে বিস্তৃত হওয়ার পর পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেলে চারা বলিষ্ঠ ও কষ্ট সহিষ্ণু হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। রাতের কুয়াশা চারার জন্য উপকারী। তাই বীজতলার আচ্ছাদন রাতে সরায়ে রাখা উচিত। বৃষ্টি বাদলের সময়ে পলিথিনের আচ্ছাদন ব্যবহার করলে চারার আলো পেতে সুবিধা হয়, অথচ বৃষ্টির ক্ষতি হতেও রক্ষা পায়।
বীজতলার রোগ ও পোকা দমন
গোড়া পচা ও ঢলে পড়া রোগ চারার প্রধান সমস্যা। ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে ও আক্রান্ত চারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বীজতলার মাটি সব সময় স্যাঁত স্যাঁতে থাকলে, ক্রমাগত মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া বিরাজ করলে ও বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটলে প্রধানতঃ এ রোগাক্রমণের আশংকা বেশি থাকে।
বপনকৃত বীজ ও চারা উভয়েই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত বীজ গজায় না এবং চারার কাণ্ড মাটির কাছাকাছি চিকন হয়ে পচে যায় ও নেতিয়ে পড়ে এবং বীজতলা ও চারার গায়ে ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়। তাছাড়া বয়ক্ষ চারার শিকড়ের অগ্রভাগ পচে যায় ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য বীজতলা আলো-বাতাসময় ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত স্থানে তৈরি করা, বীজ ও মাটি শোধন করে নেয়া এবং বীজতলা স্যাঁত স্যাঁতে ও বায়ু চলাচল বন্ধ হতে না দেয়া উত্তম। তাছাড়া এ রোগ দমনের জন্য ক্যাপ্টান, বোর্দোমিক্সার ও ডায়থেন এম বা কপার অক্সি ক্লোরাইড প্রয়োগ করা যেতে পারে। পিঁপড়া, কাটুই পোকা ইত্যাদি দমনের জন্য বীজতলার চারদিকে কেরোসিন মিশ্রিত হাই, ক্যালেখেন, সেভিন বা এ জাতীয় অন্যকোন কীটনাশক ছিটিয়ে দিতে হয়। অন্যান্য পোকার আক্রমণে কার্বোফুরান, ভেপোনা, ম্যালাথিয়ন বা সমমানের যে কোন কীটনাশক প্রয়োগ করলে উপকার পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বীজতলার চারা স্থানান্তর- ৫-৭ দিন বয়সের ৩-৪ পাতা বিশিষ্ট চারা প্রথম বীজতলা থেকে তোলে দ্বিতীয় বীজতলায় ফাঁক ফাঁক করে রোপণ ও পরিচর্যা করতে হয়। বিশেষ যত্ন ও পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেয়ে চারার পাতা, কাঞ্চ ও শিকড় দ্বিতীয় বীজতলায় সমানুপাতিকভাবে সবল ও সতেজ হয়ে পড়ে উঠতে পারে। ফলে মূল জমিতে চারা স্থানান্তরের সময় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। প্রধানত: ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলী, বেগুন, মরিচ, টমেটো ক্যাপসিকাম, তরমুজ, শশা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ প্রথা অনুসরণ করা হয়। দ্বিতীয় বীজতলায় ৫-৭ সে.মি. দূরত্বে সারি করে ৪-৫ সে.মি. পর পর ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি চারা রোপণ করা যায় এবং শশা, তরমুজ ইত্যাদি লতানো গাছের চারা পলিথিন ব্যালে স্থানান্তর করে জন্মানো হয়। স্থানান্তরের ৪-৫ সপ্তাহ পর চারা মূল জমিত রোপণ করা যায়।
চারার কষ্ট সহিঞ্চুতা বাড়ানো চারা বেশি নাদুসনুদুস, নরম, রসালো, আদুরে প্রকৃতির হলে মূল জমিতে রোপলজ- নিত আঘাত বা প্রতিকূল অবস্থা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না। তাই বীজতলার থাকা অবস্থায়ই প্রখর রৌদ্র ও শীতের প্রভাব এবং পর্যাপ্ত পানির অভাব ইত্যাদি সমস্যা ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি করে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে
অভ্যন্ত করার প্রক্রিয়াকে চারার কষ্ট সহিঞ্চুতা বাড়ানো বলে। পানি সেচ ও সুর্যালোক প্রাপ্তি নিয়ন্ত্রণ এবং ঊষ্ণ ও শৈত্য পরিবেশে বীজতলার চারা খাপে খাপে খুলে রাখার মাধ্যমে চারার কষ্ট সহিষ্ণুতা বাড়ানো সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় চারায় শ্বেতসারের সঞ্চয় বৃদ্ধি পায় যা রোপণ পরবর্তীকালে প্রচুর নুতন শেকড় গজাতে ও স্থানান্তরিত জমিতে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে। বীজতলায় বীজ বপনের ২ দিন পর হতে বীজ গজানোর হার লক্ষ রাখতে হয়। বীজ গজালে বীজতলার ঢাকনা বা চাটাই মাঝে মাঝে কিছু সময় অর্থাৎ আধাঘন্টার জন্য তুলে রাখতে হয় । পর পর কয়েকদিন ঝাপ তুলে রাখার সময় আস্তে আস্তে বাড়াতে হয় । এই ঝাপ বা চাটাই এমনভাবে খুটির উপর থাকবে যেন তা নিচের দিকে বীজতলা থেকে ১.৫ ফুট বা ৪৫° সে.মি. উপরে থাকে।
চারা রোপণের বয়স ও সময়
মূল জমিতে রোপণে সুবিধা হয় এবং রোপণের পর জমিতে সহজে লেগে যেতে পারে এমন বয়সের চারাই রোপণের জন্য উপযুক্ত। কোন চারা অনির্দিষ্টকালের জন্য বীজতলায় রাখা চলে না । কেননা বয়স্ক চারার শেকড় উঠানো কালে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায়। চারার শেকড়, কাণ্ড ও পাতা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮টি পাতা ধারণ করেই সাধারনত রোপণের উপযুক্ত হয়। তবে চারা বৃদ্ধির হার স্বাভাবিক হলে বীজ বপনের কতদিন পরে বিভিন্ন প্রকার সবজির চারা রোপণের উপযোগী হয় নিচের সারণিতে তা দেখানো হলো। চারা তোলার ৫-৭ দিন আগে থেকে বীজতলায় পানি সেচের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। এতে গাছে শর্করার পরিমাণ বেশি হয় ও চারা তোলাজনিত আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বেড়ে যায় ।
সারণিতে বিভিন্ন সবজির চারা রোপণের বয়স ও সময়
চারার রোপণ উপযোগী বয়স
মূল জমিতে রোপণ করতে সুবিধা হয় এবং রোপণের পর জমিতে সহজে লেগে যেতে পারে এমন আকৃতি ও বয়স প্রাপ্ত হলেই চারা রোপণ উপযোগী হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। অল্প বয়স্ক চারা স্থানান্তর জনিত আঘাত তেমন সহা করতে পারে না। ফলে বহুলাংশ মরে যায়। পক্ষান্তরে বয়ক্ষ চারার শিকড় বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কমে যায়। চারার শিকড়, কাণ্ড ও পাতা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮ টি পাতা ধারণ করলেই রোপণের উপযুক্ত হয়। তবে বীজতলা থেকে চারা উঠানোর অন্তত : ১ (এক) ঘন্টা পূর্বে একবার হালকা সেচ দিতে হয়। এরপর মাটি শুকিয়ে এলে চারা উঠাতে হয়। তাতে চারার শেকড় কম ছিড়ে ও রোপপানিত আঘাত দ্রুত সেরে উঠে। চারা উঠানোর সময় চিকন কাঠি দিয়ে মাটিতে চাড় দিয়ে চারার পায়ে হালকাভাবে ধরলে সহজেই চারা উঠে আসবে। এছাড়া খুরপি বা অগার দিয়েও বীজতলা হতে আলতাভোবে চারা উঠানো যায়। চারার গোড়ার মাটির বলসহ উঠানো চারা গর্তে বলসহ রোপণ করলে সে চারা সাধারণত রোপণজনিত আঘাত পায় না। তাই এই চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
বীজতলা হতে কাঠি দিয়ে চারা উঠালে চারার শিকড় সাধারণত নগ্ন হয়ে যায়। এ সময় চারার অতি কোমল কাজে হাত না লাগিয়ে আলতোভাবে প্রতিটি চারার পাতায় ধরতে হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে নগ্ন চারা লাগালে চলে পড়তে পারে বা শুকিয়ে যেতে পারে। তাই একটি পাত্রে অর্ধেক পানি নিয়ে একটি একটি করে উঠায়ে ভাতে জড়ো করতে হয়। এ ব্যবস্থা করা হলে চারা চলে পড়বে না বা শুকিয়ে যাবে না।
প্রখর রোদের সমর চারা উঠানো অনুচিত। অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রা এবং বাতাসে বেশি জলীয়বাষ্প থাকাকালীন সময় চারা তোলা সবচেয়ে ভাল। বিকেলে সূর্য ডুবার পূর্ব মুহুর্তে মাঠে চারা রোপণ করা উচিত। রাত্রিকালীন কুয়াশা ও শিশির বাতাসে অধিক জলীর বাম্প সৃষ্টি করে যা চারাকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে। এসময় চারার সালোক সংশ্লেষণ হার কম হয়। বিকেলে রোপণের পর মাটিতে শিকড় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চারা প্রায় ১২-১৪ ঘন্টা উপযুক্ত পরিবেশ পায়। এতে রোপণ পরবর্তী চারার মৃত্যুহার কমে যায়।
চারা উঠানোর পর যতশীঘ্র সম্ভব রোপন করতে হয়। রোপণের সময় নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের কাঠি দিয়ে একটি গর্ভ করে নিয়ে তারপর ঐ গর্তের মধ্যে শেকড়সহ চারাটি বলারে দিতে হয়। বীজতলায় যে গভীরতা হতে চান্না উঠানো হয় গতটির গভীরতাও তার সমান হতে হয়। সাধারণত এ গভীরতা ৫-৮ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে। চারাটি গর্তে স্থাপনের পর আগুল দিয়ে চারার গোড়ার দুদিকের মাটি আস্তে আস্তে সামান্য চেপে দিতে হবে। যাতে গোড়ার শেকড়ের গারে মাটি লেগে যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন চারার গোড়া ও কাণ্ড সোজা থাকে। চারা বাঁকা করে লাগানো মোটেই উচিত নয়। কোন কারণে চারা উঠানোর পর রোপণে দেরি হলে চারাগুলো গুছিয়ে মুঠি আকারে বেঁধে ঠাণ্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হয় এবং সতর্কতার সাথে নড়াচাড়া করতে হয়।
চারা রোপণ প্রবর্তী পরিচর্যা-চারা রোপণের পর চারার গোড়ায় ৩-৪ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে পানি দিতে হয়। এই সেচের পানি চারার শেকড়কে মাটির আরো অধিক সংস্পর্শে আসতে সাহায্য করে। চারা রোপণের পরের দিন সূর্যতাপ হতে চারাকে বাঁচানারে জন্য ছায়া দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এ ব্যবস্থা না করা হলে চারা অত্যধিক প্রস্বেদনের কারণে শুকিয়ে মারা যেতে পারে বা ভীষণ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। কারণ মাটিতে শেকড় ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত চারার প্রস্বেদন ও রস শাষেণের মধ্যে ভারসাম্যতা বজায় থাকে না। তাই ৩/৪দিন অব্যাহত ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে রাতের বেলায় শিশির পড়ার জন্য ঢাকনা সরায়ে দিতে হয়। চারা মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হলে মাঝে মাঝে চারার গোড়ার চারিদিকের মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হয়। পেঁপে, বেগুন, মরিচ, পুঁই, শালগম, শিম, লাউ, কুমড়া জাতীয় ইত্যাদি চারা রোপণে বিশেষ যত্নবান হতে হয়। কারণ এগুলো মরে যাবার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ব্রকোলি, বিট, ফুলকপি, লেটুস, টমেটো, সিলারী, চিনা বাঁধাকপি, পটল, কাঁকরোল, পেঁয়াজ, কাঁচকলার চারা ইত্যাদি রোপণের আঘাত সহ্য করে সহজেই বেঁচে উঠতে পারে।
পোকামাকড়ঃ রোগবালাই দমন- চারা রোপণের পর প্রথম অবস্থায় যদি গাছের ২-১টি পাতার বা ভালে পাকামাকড়ের ডিম বা কীড়া দেখা দেয়, তাহলে সেগুলো হাত দিয়ে সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হয়। এতে ফসল মাটি ও পরিবেশ রক্ষা পায়, ঔষধ থে করার খরচ বাঁচে, ডিম ফুটে পোকা ছড়াতে পারে না।
বেগুন, লাউ, শশা, কুমড়াজাতীয় ইত্যাদি চারাতে সকাল বেলা পাতায় শিশির থাকা অবস্থায় ছাই ছিটিয়ে দেওয়া যায়। এতে বিটলজাতীয় পোকা ও পিপড়ার উপদ্রব কমে যায়। এছাড়া চারা আক্রান্ত হলে ডাল ও পাতা ছেটে দেওয়া যায়। আবার অনেক সমর চারা ছোট থাকলে আক্রান্ত চারা তুলে ফেলতে হয়। আক্রমণ খুব বেশি হলে পোকামাকড় দমনের জন্য বালাইনাশক যেমন- নগজ, ডেপোনা, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন, নেক্সিয়ন, ফেনিটধিরন, মেটাসিসটোর ইত্যাদি সেব করতে হয়। আর রোগবালাই বা ছত্রাক দমনের জন্য ছত্রাকনাশক যেমন- বোর্দোমিক্সার, টিট, কপার অক্সিক্লোরাইড, ডায়াথেন এম-৪৫ ইত্যাদি স্প্রে করতে হয়।
সবজির অঙ্গজ বংশ বিস্তার
আমাদের দেশে কিছু কিছু সবজি আছে যেগুলোর আদৌ বীজ তৈরি হয় না বা তাদের বীজ তৈরি করা কষ্টসাধ্য। আবার, যে ধরনের বীজ উৎপাদন করে তা যারা সুস্থ ও সবল চারা উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তাই এই সমস্ত সবজির বংশবিস্তারে বা চাষাবাদের জন্য বীজের পরিবর্তে অঙ্গ ছাড়া অন্য কোন সহজ উপায় নেই। যেমন- কাঁচকলা, গোলআলু, মিষ্টি আলু, কচু, পটল, মেটে আলু, রসুন, আদা ইত্যাদি। অঙ্গজ বংশবিস্তারের কারণ।
যথা- (ক) কিছু গুরুত্বপূর্ণ সবজি আছে যেমন- পটল, কাঁকরোল, ডুমুর, কাঁচকলা প্রভৃতি ধরনের গাছ সুস্থ সবল ও প্রকৃত বীজ উৎপাদন করতে পারে না। তাই এসব গাছের বংশকে টিকিয়ে রাখার জন্য অঙ্গ পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করতে হয়।
(খ) বীজ থেকে উৎপাদিত গাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাতৃগাছের গুণাগুণ বজায় থাকে না। তাই মাতৃগুণ সম্পন্ন গাছ পেতে হলে অঙ্গজ পদ্ধতিতে নতুন গাছ উৎপাদনের প্রয়োজন হয় ।
(গ) অনেক গাছের বীজ খুব ধীরে ধীরে গলায় এবং বীজে সজীবতা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অঙ্গজ বংশবিস্তার ছাড়া বিকল্প পন্থা থাকে না।
(ঘ) কুমড়াজাতীয়, বেগুন, টমেটো, শশা ইত্যাদির এমন কতগুলো লাভ আছে যেগুলো উচ্চ ফলনশীল। কিন্তু খরা, জলাবদ্ধতা, রোগ, পোকামাকড় ইত্যাদির প্রতি অধিক সংবেদনশীল। এক্ষেত্রে ঐসব জাতের গাছের বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে ফসল হিসেবে চাষ করা হয় না। তাই প্রতিকূল অবস্থার সাথে খাপ খার এমন কোন গাছের সাথে কলম করে চাষ করা হয়। যেমন- বেগুনের সাথে জংলি বেগুন, কুমড়ার সাথে শশা ইত্যাদি।
(ঙ) অঙ্গজ পদ্ধতিতে জন্মানো গাছ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আকারে ছোট হয় এবং শিকড় খুব মজবুত হয়। এজন্য ফল সংগ্রহ ও পরিচর্যা সহজ হয়। ফলের সংখ্যা বেশি ও আকৃতিতে বড় হয়। অল্প জায়গাতে বেশি করে গাছ লাগানো যায়।
(চ) এ পদ্ধতিতে নতুন পাছ তৈরিতে কোন কোন ক্ষেত্রে সময় কম লাগে, খরচ কম এবং পদ্ধতিও অনেকটা সহল। যেমন-কচু, আলু, কাঁকরোল, পটল, মেটে আলু, লাহু আলু ইত্যাদি।
সবজির অঙ্গজ বংশবিস্তারের উপকরণ
সবজির অঙ্গজ বংশবিস্তারে ব্যবহৃত উপকরণগুলো হলো সবজির শাখা ও রূপান্তরিত বিভিন্ন অঙ্গ। নিচে বিভিন্ন প্রকারের অঙ্গের নাম উল্লেখ করা হলো। যেমন-
শাখাকলম, শুল্ক কন্দ, কন্দ স্ফীতিকন্দ, গুড়িকন্ড বা করম, গুড়িচারা বা বক্রধারক, ধাবক, রাইজোম, টিউবারকল, কন্দমূল, মুকুট ইত্যাদি।
১। শাখাকলম সাধারণত কোন গাছের কাণ্ডের টুকরা বা অংশ ব্যবহার করে নতুন গাছ উৎপাদন করা হয়। কাণ্ডের প্রতিটি টুকরার কমপক্ষে একটি করে লাইক বা গিরা বা পর্ব থাকতে হয়। উদাহরণ মিষ্টি আলুর লতা, পুঁইশাক, কলমিশাক, পটল, সাজিনা ইত্যাদি শাখা কলমের সাহায্যে বংশবিস্তার করে থাকে। রোপণের সমর কাণ্ডের টুকরার তিনভাগের দুই ভাগ মাটির নিচে পুঁতে দিতে হয় এবং এক ভাগ মাটির উপরে রাখতে হয়।
১। শুল্ক -এটি একটি বিশেষ ধরণের ভূনিম্নরূপান্তরিত কাঞ্চ। এ কান্ড খাটো প্রকৃতির এবং অর্ধপালোকার চাকতির মতো। এতে রসালো তরপত্র একটির পর একটি অর্ধগালোকারভাবে সাজানো থাকে। সমস্ত প্রহ্মপত্রগুলো শুক্র কিশী দ্বারা আবৃত থাকে। আপত্রগুলো হলো পাতার রূপান্তরিত নিচের অংশ। শুল্কপত্রে একটি শীর্ষমুকুল থাকে, যা থেকে নতুন গাছের সৃষ্টি হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে শুল্ক কন্দের কাক্ষিক মুকুলও থাকে। এসব কাক্ষিক মুকুল ক্ষুদ্রাকার কন্দে পরিণত হয়ে কোয়ার রূপধারণ করে। উদাহরণ- পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি।
৩। স্ফীত কন্দ এটি একটি ভূনিম্নস্থ রূপান্তরিত কার বা টিউবার। এর পায়ে অনেক চোখ থাকে এবং এ চোখেই কুঁড়ি থাকে। এই কুঁড়ি হতে নতুন গাছের জন্ম হয়। উচ্চারণ- গোল আলু।
৪। গুড়িকন্দ বা কলম- এটি ভূমিম্নস্থ সকল কান্ডের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং মাটির নিচে সাধারণত খাড়াভাবে অবস্থান করে। কোন কোন কাক্ষিক মুকুল খাদ্য সঞ্চয় করে স্ফীত হয়ে ছোট ছোট ঋত্বিকদের সৃষ্টি করে। এই গুড়িকন্দ হতে আলাদা আলাদাভাবে নতুন গাছের জন্য দেয়। যেমন-ওলকচু।
৫। গুড়িচারা বা বক্র ধাবক কোন কোন উদ্ভিদের মাটি সংলগ্ন কাও বা মূল থেকে পার্শ্বমুকুল বের হয়। এ পার্শ্বমুকুল বেড়ে একটি পূর্ণাণ উদ্ভিদে পরিণত হয়। কচু গাছের কাণ্ডের গোড়া হতে গুড়িচারা বের হয়।
এটি একটি লতানো গাছ এবং এর গিরা (পর্ব) হতে পার্শ্বমুকুল বের হয়ে সরু লম্বা হয়ে যায়। এই লম্বা শাখা মাটিকে স্পর্শ করে সমান্তরালভাবে থাকে। কিছুদুর যাবার পর অগ্রভাগের গিরার (পর্ব) নিচের দিকে অস্থানিক মূল এবং উপরের দিকে পাতা বের হয়। পরবর্তীতে প্রতিটি পর্ব হতে এক একটি কুঁড়ি বের হয়ে স্বতন্ত্র গাছে পরিণত হয়। যেমন-থানকুনি, আমরুল, টোপাপানা ইত্যাদি।
৭। রাইজোম— এটি একটি ভূনিম্নস্থ রূপান্তরিত কাজ এবং মাটির নিচে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। এতে পা, মধ্যপর্ব, রপত্র, শুল্কপত্রের কক্ষে কক্ষমুকুল এবং অগ্রভাগে অগ্রমুকুল থাকে। আদা ও হলুদের বংশবিস্তারে রাইজোম ব্যবহৃত হয়।
৮। টিউবারকল-কাণ্ডের ভূ-উপরস্থ অংশে অর্থাৎ লতার পর্বে (পাতার বোটায়) অনেক সময় স্বাভাবিক শাখা বের না হয়ে মাংসল অঙ্গ সৃষ্টি করে। এদেরকে টিউবারকা বা বুলবিল বলে। চুলছি আদুর বিভিন্ন জাত টিউবারকলের সাহায্যে বংশবিস্তার করে থাকে।
৯। কন্দমূল-এটি একটি ভূ-নিম্নস্থ রূপান্তরিত মূল। এদের গায়ে অস্থানিক কুঁড়ি থাকে, যা থেকে চারা বের হয়। মিষ্টিআলু, কাঁকরোল, চারকোণী শিষ ইত্যাদি কন্দমূলের সাহায্যে বংশবিস্তার করে।
১০। মুকুট - কিছু কিছু সবজির পুষ্ট উন্নতমানের বীজ উৎপাদনের জন্য ভক্ষণযোগ্য কিছু অংশ এবং পাতার উপরের অংশ কিছুটা কেটে বীজতলায় রোপণ করা হয়। এতে মূল জমি মুক্ত হয়ে যায় এবং অল্প পরিসরে পরিচর্যার মাধ্যমে বেশি পরিমাণ বীজ উৎপাদন করা যায়। যেমন- মুলা, গাজর, বীট, শালগম ইত্যাদি।
এক কথায় উত্তর
১. বীজ ছিটিয়ে বপন করলে সারিতে বপন অপেক্ষা কতগুণ বীজ বেশি লাগে?
২. পালংশাকের জন্য এক হেক্টরে কত গ্রাম বীজ লাগে?
৩. বীজতলায় চারা হতে চারা কত সে.মি. দূরে দূরে রাখলে চারা সুষ্ঠুভাবে বড় হতে পারে?
৪. চারা বাঁকা হওয়া রোধে কতবারে চারার গোড়ায় ঝুরঝরে মাটি দিতে হয় ?
৫. বীজতলায় পিপড়ার আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার্য ১টি কীটনাশকের নাম লেখ।
৬. দ্বিতীয় বীজতলায় কতদিন বয়সের চারা স্থানান্তর করা যায় ?
৭. ফুলকপির চারা রোপণ উপযোগী বয়স কতদিনে হয় ?
৮. কোন সময় চারা রোপণ করলে প্রতিষ্ঠিত হতে ১২-১৪ ঘন্টা সময় পায় ?
৯. অঙ্গজ বংশ বিস্তার হয় এমন ১টি সবজির নাম লেখ ৷
১০. রেটুন বা মুড়ি ফসল হয় এমন ১টি সবজির নাম লেখ ।
১১. কন্দমূলের ১টি উদাহরণ দাও।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. বীজ হার বলতে কী বোঝায় উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।
২. ৫টি সবজি বীজের বীজসংখ্যা/গ্রাম, বীজ হার শতক ও বীজ হার/হেক্টর উল্লেখ কর ।
৩. বীজতলার রোগ ও পোকামাকড় দমন সম্পর্কে বর্ণনা কর ।
৪. ৫টি সবজির চারা রোপণের বয়স ও সময় সম্পর্কে লেখ।
৫. চারা রোপণ পরবর্তী পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন সম্পর্কে লেখ।
৬. সবজির অঙ্গজ বংশ বিস্তারে শুল্ক কন্দ ও স্ফীত কন্দ সম্পর্কে উদাহরণসহ লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. বীজতলায় বীজ বপন ও বীজতলার চারার পরিচর্যা, রোগ ও পোকা দমন সম্পর্কে বর্ণনা কর।
২. চারা রোপণ পূর্ব প্রস্তুতি এবং রোপণ প্রক্রিয়াসমূহ ধাপে ধাপে বর্ণনা কর।
৩. চারা রোপণ পূর্ব প্রস্তুতি এবং রোপণ প্রক্রিয়াসমূহ ধাপে ধাপে বর্ণনা কর।
৪. চারা রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে বর্ণনা কর।
৫. সবজির অঙ্গজ বংশ বিস্তার বলতে কী বোঝায় এবং বংশ বিস্তারে ব্যবহৃত ৩টি উপকরণের ছবিসহ ব্যাখ্যা কর।
টিকা লেখ
১) চারার কষ্ট সহিষ্ণুতা, (২) বীজতলায় বীজ বপন ৩) দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তর।